জীবনের বাঁকে বাঁকে

অন্ধদের মাদ্রাসা

সেদিন সন্ধ্যায় ছেলের হাত ধরে হাটছি। হঠাৎ রাস্তার অপর পাশ দিয়ে একটা কিশোরকে হেঁটে যেতে দেখলাম। হাতে সাদা ছড়ি। খুব করুণ গলায় ভিক্ষা চাইছে। এই দুনিয়াতে সে কিছু দেখতে পায় না। এমনিতে ঘটনাটা গা সওয়া হয়ে গেছে। অন্ধ মানুষতো থাকবেই। পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষের মধ্যে তিন কোটি নব্বই লক্ষ মানুষ অন্ধ। তার চোখ নেই–আমি কী করতে পারি?

সেদিন কেন যেন খুব খারাপ লাগল। এই যে আমি লাফ দিয়ে ফুটপাথ থেকে রাস্তায় নামছি, সে পারছে না। কতবার ছড়ি ঠুকে তারপর নামে। আমি কালো আর সবুজ রঙের তরমুজ ছেলেকে দেখাই, সে হয়ত দয়া করে কেউ দিলে একটা টুকরো খায়। তার জীবন আর আমার জীবনে কত তফাত! অথচ এই তফাতে আমার যেমন কৃতিত্ব নেই, তারও কোনো দোষ নেই। সবই আল্লাহর ইচ্ছে, আল্লাহর পরীক্ষা। সে কতটা ধৈর্য ধরে আর আমি তার জন্য কী করি।

আমি একজন মানুষকে চিনি। সৈয়দ ইমামুল হাসান, এলজিইডিতে কাজ করেন। ভদ্রলোকের চোখ নষ্ট। এখন সামান্য দেখেন, সামনে পুরো অন্ধ হয়ে যাবেন। অনেক চিকিৎসা করেছেন–সব ডাক্তারের একই মত। অন্য কেউ হলে কান্নাকাটি করত, কিন্তু তিনি এক আজব কাজ করলেন—তার পৈত্রিক ভিটার জমিটুকু একটা মাদ্রাসার নামে ওয়াকফ করে দিলেন। মাদ্রাসার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি অন্ধদের মাদ্রাসা। শুধু অন্ধদের জন্য। নানা বয়সী অন্ধ। তারা সবাই এখানে কুর’আন হিফজ করে। ইমাম ভাই রাস্তা থেকে ভিক্ষে করা অন্ধ ছেলে ধরে আনেন। তাদের খাবার দেন, ব্রেইল কুর’আন শেখান। এরপর কুর’আন মুখস্থ করান। একজন অন্ধ হাফেজ মাসজিদে ইমামতি করতে পারেন। ভিক্ষা করার চেয়ে সলাত পড়ানো ভালো।

তার মাথায় আরো নানারকম বুদ্ধি ঘোরে। তিনি শব্দ-করা বল এনেছেন। মাদ্রাসার ছেলেরা সেটা দিয়ে ক্রিকেট খেলে। তিনি এক কম্পিউটার সেন্টারে ধর্ণা দিয়ে ব্যবস্থা করেছেন—কিছু ছেলে যেন কম্পিউটার শেখে। শিখে কী করবে তিনি জানেন না। তিনি খালি ভাবেন—ভিক্ষা করবে কেন? একটা মানুষ অন্ধ বলে ভিক্ষা করবে কেন? ইমাম ভাই আমাদের কাছ থেকে কম্বল নিয়ে তার ছাত্রদের দিয়েছেন। পুরনো কাপড় নিয়ে গেছেন। মাদ্রাসাতে ভাত বাড়ন্ত হলে চালের দাম। কুরবানির সময় খাশির টাকা। পঞ্চাশজন অন্ধের হয়ে তিনি খুব ভদ্রভাবে হলেও ভিক্ষা-ই করেন।

অনেকদিন পেছনে লেগে আছেন ইমাম ভাই। তিনি মারা গেলে মাদ্রাসাটা কে দেখবে? কে অন্ধ মানুষ যোগাড় করবে? কে মাদ্রাসা চালানোর খরচ যোগাড় করবে? তার অনুরোধ যেন একটিবার মাদ্রাসাটি দেখে আসি। তিনি যখন ফোন দেন অপরাধবোধে ভুগি কিন্তু তাও সময় করতে পারি না। পরিচিত কয়েকজন ভাইকে বলেছিলাম, তারাও সময় করতে পারেন না। সেদিন সন্ধ্যার অন্ধ ছেলেটিকে দেখার পরে নিয়াহ করলাম—এবার যাব। আমার চশমাটা খুলে নিলে আমিও যে কিছু দেখি না। গন্তব্য ফরিদপুর গের্দা প্রতিবন্ধী মাদ্রাসা ও ইয়াতিমখানা। ২ মে, শুক্রবার ভোরে গিয়ে সন্ধ্যার মধ্যে চলে আসব ইন শা আল্লাহ। একবেলা মানুষগুলোকে দেখব। তাদের সাথে একবেলা ডাল-ভাত খাব। আল্লাহর দেওয়া চোখজোড়ার ন্যুনতম কৃতজ্ঞতা আদায় করা আরকি।

আল্লাহ অন্ধ মানুষদের অনেকগুলো প্রশ্ন করবেন না, আমাদের করবেন। সেই প্রশ্নের উত্তর কী দেব জানি না। চোখের পাপের জবাব। যে চোখ ব্যবহার করে আল্লাহ প্রতিদিন রিযক যোগাড় করে দিচ্ছেন সেই চোখের মালিকের প্রতি অকৃতজ্ঞতার জবাব। আমি মা-বাবা-স্ত্রীকে বলে রেখেছি, মারা গেলে যেন চোখটা অন্ধদের দেওয়া হয়। কিন্তু সেটা তো মরে গেলে। বেঁচে থাকতে কী করলাম? একজন অন্ধ ভিক্ষুকের হাতে দশ টাকা ধরালে কী আসলে চোখের কৃতজ্ঞতা আদায় হয়? নয়টা-পাঁচটা চাকরত্বের শৃংখলা কী টিকত যদি আমাদের এই চোখটা না থাকত? যে যাই করছি, চোখজোড়া না থাকলে কী করতে পারতাম? কোনো একটা দুর্ঘটনায় যদি আমাদের চোখ হারিয়ে যায় আমাদের এত ভালোবাসার-ব্যস্ততার কর্মক্ষেত্রটি ক’দিন বসিয়ে খাওয়াবে? অন্ধদের করার মতো ক’টা কাজ আছে? নিজেকে দিয়ে যদি আমরা চিন্তা করি—চোখ হারালে মানুষের দয়াই ভরসা হবে এই আমাদের।

যেসব ব্যস্ত মানুষের চোখে এ বার্তাটি পড়ল তারা যেন একটু দু’আ করবেন—শুধু দান না, আমরা যেন ইমাম ভাইয়ের মতো কিছু মানুষ পাই। যারা দায়িত্ব নিতে রাজি। আল্লাহর ওয়াস্তে সময়, শ্রম এবং মেধা ব্যয় করতে তৈরি। সমাজের যেসব মানুষদের আল্লাহ সীমাবদ্ধতা দিয়েছেন তাদের জন্য যেন আমরা অর্থবহ কিছু করতে পারি—এই দু’আটুকু করবেন।

– শরীফ আবু হায়াত অপু

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button